সমাজতত্ত্বের সংজ্ঞা দাও। সমাজতন্ত্রের সঙ্গে অর্থনীতির সম্পর্ক আলোচনা কর।


সমাজতত্ত্বের সংজ্ঞা দাও। সমাজতন্ত্রের সঙ্গে অর্থনীতির সম্পর্ক আলোচনা কর। Discuss the relationship between socialism and economics

<b>{tocify} $title={Table of Contents}</b>

ভূমিকা : 

সমাজতত্ত্ব শাস্ত্রটি অপেক্ষাকৃত আধুনিক হলেও এর জন্মকালীন ইতিহাস খুব নগন্য নয়। সমাজতত্ত্ব বা Sociology পৃথক শাস্ত্র হিসেবে প্রথম স্বীকৃতি পায় ১৮৩৯ সালে। সমাজবিজ্ঞানী অগস্ট কোঁত (Auguste Comte) তাঁর 'Course de positive philosophy' গ্রন্থে প্রথম এই শব্দটি ব্যবহার করেন।


সমাজতত্ত্বের সংজ্ঞা :

সমাজতত্ত্বের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে মরিস জিন্সবার্গ (M. Gibsherg) মনে করেন, সমাজতত্ত্ব হল মানুষের সকল পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও পারস্পরিক সম্পর্ক, তাদের সকল অবস্থা ও ফলাফল সম্বন্ধে আলোচনা।


সমাজতত্ত্ব সম্পর্কে অধ্যাপক গিডিংস-এর মত :

অধ্যাপক গিডিংস (F.H. Giddings) বলেন, সমাজবিজ্ঞান হল মানুষের মানসিক সংযোগের বিজ্ঞান। সমাজতত্ত্ব বিশেষভাবে কার্যকারণ সম্পর্কিত ও সামাজিক ঘটনাগুলির ব্যাখ্যা, মানুষের ক্রিয়াকলাপ, সমাজের আঙ্গিক সামঞ্জস্য বিধান, শক্তি সংরক্ষণের পরিপ্রেক্ষিতে সামাজিক ঘটনার তাৎপর্য নিরূপণের বিজ্ঞান।


অর্থনীতি এবং সমাজবিদ্যা : 

অর্থনীতিবিদ হিসেবে সবার প্রথম নাম আসে অ্যাডম স্মিথ এবং গিনিসের। স্মিথ এবং গিডিনস সর্বপ্রথম অর্থনীতির সঙ্গে সমাজ বিজ্ঞানের সম্পর্কের কথা দাবী করেন। তবে এই অভিমতের পূর্বে পর্যন্ত সমাজ বিজ্ঞান ও অর্থনীতিকে দুটি পৃথক পৃথক বিজ্ঞান হিসেবেই দেখা হত। গিডিনস্ ও স্মিথের মতের সমর্থন করেন Kari Marks, J. Schumpter. সমাজবিজ্ঞানের সঙ্গে অর্থনীতির সম্পর্ক তাছাড়া সামাজিক বিজ্ঞানের আলোচনার ক্ষেত্রে যেমন অর্থনীতির প্রয়োজন অবশ্যম্ভাবী তেমনি অর্থনীতির ক্ষেত্রে সমাজ বিজ্ঞানের বিশেষ অবদান রয়েছে, এই মতের সমর্থন করেন বটোমোর।


সাদৃশ্য :


১. সমাজতত্ত্ব ও অর্থনীতির মধ্যে যোগসূত্র : 

আধুনিক সমাজতত্ত্ববিদেরাও বিভিন্ন দিক থেকে অর্থনীতি এবং সমাজতত্ত্বের মধ্যেকার যোগসূত্রের বিষয়টিকে বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করেছেন। যে সকল সমাজবিজ্ঞানীরা অর্থনীতি ও সমাজতত্ত্বের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করেছেন তাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য হলেন ম্যাক্স ওয়েবার। ম্যাক্স ওয়েবার পুঁজিবাদের উদ্ভব ও বিকাশের আলোচনার ক্ষেত্রে তিনি মানুষের অর্থনৈতিক চিন্তাভাবনা এবং কার্যকলাপের উপর সামাজিক অবদান হিসেবে ধর্মের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবের কথাও বলেছেন। বিভিন্ন অর্থনীতিবিদ্রাও সামাজিক অবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন অর্থনৈতিক পর্যালোচনাকে ভ্রান্তিকর এবং অসম্পূর্ণ বলে মনে করেন।


কার্ল মার্কস :

অর্থনৈতিক ও সমাজতাত্ত্বিক আলোচনার ক্ষেত্রে কার্ল মার্কসের অভিমত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অর্থনৈতিক কার্যকলাপের সঙ্গে সমাজের যোগসূত্রের বিষয়টি সবচেয়ে গভীরভাবে বিশ্লেষণ করার প্রচেষ্টা পরিলক্ষিত হয়। কার্ল মার্কস অর্থনৈতিক কার্যকলাপের মূল কেন্দ্র অর্থাৎ উৎপাদন ব্যবস্থাকে যে কোন সমাজের মূল ভিত্তি হিসেবে নির্দেশ করেছেন। তাছাড়া তিনি মনে করেন যে মূহূর্তে উৎপাদন পদ্ধতি ও উৎপাদন ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটে, সেই মুহূর্তে মৌলিক কাঠামো অর্থাৎ সমগ্র সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটে থাকে।


২. পারস্পরিক নির্ভরশীলতা :

বি. বটোমারের অভিমতে অর্থনীতিগত কার্যকলাপের সঙ্গে উত্তরোত্তর সামাজিক সম্পর্ক ও সামাজিক কাঠামোগত যোগসূত্র স্থাপিত হয়ে থাকে। এই ধরণের পরস্পর নির্ভরশীলতার বিষয়টি অত্যন্ত স্বাভাবিক। তাই স্বভাবতই দেখা যায় অর্থনীতি এবং সমাজ বিজ্ঞানের মধ্যেকার পারস্পরিক নির্ভরশীলতা ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়েছে।


ক. আধুনিককালে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক বিশ্লেষণের পরিবর্তে সমষ্টিগত স্তরে সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের গুরুত্ব ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে।


খ. অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অন্তর্গত উৎপাদন পদ্ধতি, শ্রমবিভাজন, প্রাক্ শিল্পযুগীয় অর্থনীতি ও শিল্পভিত্তিক অর্থনীতির আলোচনার ক্ষেত্রে অপরিহার্যভাবে সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করা অত্যন্ত দরকারি হয়ে পড়ে। সমাজতাত্ত্বিক আলোচনা ছাড়া অর্থনৈতিক বিচার-বিশ্লেষণ করা সম্ভবপর নয়। এই ক্ষেত্রে এমিল দ্যুরখাইম, ম্যাক্স ওয়েবার প্রমুখ সমাজতত্ত্ববিদদের কথা বলা যায়। বিশ্ব অর্থনীতির উন্নয়নের পরিকল্পনার ক্ষেত্রে নীতি নির্ধারণ প্রমুখ বিষয়ে। এবং বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে সমাজতাত্ত্বিক সমীক্ষার গুরুর ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে।


৩. বিষয়বস্তুর দিক থেকে নির্ভরশীলতা : 

সমাজ বিজ্ঞান ও অর্থনীতির মধ্যেকার যোগসূত্রের ফলে অর্থনীতি ও সমাজতত্ত্ব উভয় বিষয়ের ক্ষেত্রে একাধিক তত্ত্ব গড়ে উঠেছে এই প্রসঙ্গে ম্যাক্স ওয়েবার, কার্ল মার্কস, ট্যালকট পারসন, দ্যুরখাইম প্রমুখদের কথা বলা যায়। বিষয়বস্তুর দিক থেকে অর্থনীতি ও সমাজতত্ত্বের মধ্যে পারস্পরিক নির্ভরশীলতা দেখা যায়।


বৈসাদৃশ্য : 

ক. সমাজতত্ত্ব ও অর্থনীতির মধ্যে আলোচনারা পরিধির ক্ষেত্রের পরিপ্রেক্ষিতে পার্থক্য দেখা যায়। সমাজতত্ত্বে সমগ্র সমাজের আলোচনার সামগ্রিক তত্ত্ব পাওয়া যায়। এই কারণবশত সমাজতত্ত্বের আলোচনার পরিধি অনেক বেশী ব্যাপক অন্যদিকে অর্থনীতির ক্ষেত্রে সমাজের কোন একটি নির্দিষ্ট দিক নিয়ে আলোচনা করা হয়। সুতরাং সমাজতত্ত্বে সমাজের বিভিন্ন দিকের আলোচনা করা হয়। সমাজতত্ত্বের আলোচনার প্রকৃতি ও পরিধি ব্যাপক। অন্যদিকে অর্থবিদ্যা ক্ষেত্রে সমাজের কেবলমাত্র ব্যক্তিবর্গের অর্থনী দিক সম্পর্কে আলোচনা করা হয়। এই ক্ষেত্রে বিদ্যাভূষণ ও সহদেবের মতবাদ উল্লেখযোগ্য the field of Economics is restricted only to the economic activities of man where as sociology is concerned with all the relationship which are not simole economic but social.",

খ. সমাজতত্ত্বের ও অর্থনীতির অনুশীলনের ক্ষেত্রেও পার্থক্য দেখা যায়। সমাজতত্ত্বে সমাজের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ও অনুশীলন করা হয়। তবে অর্থনীতির আলোচনা কোন ব্যক্তি বিশেষ অথবা সমাজের অর্থনীতিগত বিষয়ে কেবলমাত্র অনুশীলন করা হয়। তাই উভয়ের অনুশীলনের ক্ষেত্রে পার্থক্য দেখা যায়।

গ. সমাজতত্ত্ব ও অর্থনীতির আলোচনার ক্ষেত্রে পৃথক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা হয়। যেমন সমাজতত্ত্বের বিষয়বস্তু আলোচনার ক্ষেত্রে একটি সার্বিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা হয়। অন্যদিকে অর্থনীতির বিষয়বস্তু আলোচনার ক্ষেত্রের সমাজবদ্ধ মানুষের অর্থনৈতিক কার্যকলাপ, আচার-আচরণ প্রমুখ বিষয়ে বিশ্লেষণ করা হয়।

ঘ. উৎপত্তিগত ক্ষেত্রে সমাজতত্ত্ব ও অর্থনীতির মধ্যে পার্থক্য বিদ্যমান। প্রকৃতপক্ষে সমাজবিজ্ঞান একটি নবীন সামাজিক বিজ্ঞান। অন্যদিকে অর্থবিদ্যার উৎপত্তি হয়েছে অনেক আগে এবং অর্থবিদ্যা বহু আগেই একটি প্রতিষ্ঠিত সামাজিক বিজ্ঞানের মর্যাদা লাভ করেছে।

মন্তব্য : 

উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় সমাজতত্ত্ব ও অর্থবিদ্যা হল দুটি স্বতন্ত্র সামাজিক বিজ্ঞান। এই দুটি সামাজিক বিজ্ঞানের মধ্যে গভীর ও নিবিড় সম্পর্ক বিদ্যমান আলোচনার ক্ষেত্রে দুটির যে কোন একটির ক্ষেত্রে সঠিক ও সম্পুর্ণ জ্ঞান অর্জনের স্বাথে অন্যটির বিষয়বস্তু সম্পর্কেও সম্যকভাবে অবহিত হওয়া প্রয়োজন। এই দুটি সামাজিক বিজ্ঞানে পারস্পরিক নির্ভরশীলতার সম্পর্ক বিরোধ বিতর্কের উর্ধ্বে। এক্ষেত্রে T.B. Bottomor তাঁর 'Sociology' শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন - "It can be argued that sociolog and economics, which were very closely related at their origins e.g, the work of Quesmay and Adam Smith, but which then diverged, exce in the work of German historical economics, have come closer togeth again in recent years." 

Post a Comment

Previous Post Next Post